নবী করীম (সাঃ)-এর বাল্যজীবন ।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাল্যজীবন।
আল্লাহ তা'আলা যাকে বিশ্বমানবের জন্য পথ-প্রদর্শকরূপে মনোনয়ন করিয়া দুনিয়ায় প্রেরণ করিয়াছেন তাঁহার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে এবং প্রতিটি স্তরে অন্য মানুষের সাথে পার্থক্য এবং স্বাতন্ত্র্য থাকা অনিবার্য। রাসূলে করীম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ক্ষেত্রে ইহার নিদর্শন দেখা গিয়াছিল পুরা মাত্রায়। তাঁহার বাল্যে দেখা গিয়াছিল অন্যান্য বালকদের চরিত্রের সাথে তাঁহার চরিত্রের কোন মিল নাই।
তিনি শৈশব হইতেই ছিলেন স্বল্পভাষী ও ধীরস্থির প্রকৃতিসম্পন্ন। অধিক চঞ্চলতা তাঁহার মধ্যে ছিল না।খেলা-ধূলা, বাজে কথা তিনি মোটেই ভালবাসিতেন না। তাঁহার সমবয়সী বালকগণ যখন খেলা-ধূলায় মত্ত হইত, তখন তিনি প্রান্তরের পার্শ্বে বসিয়া একাকী কি যেন চিন্তা করিতেন। কেহ কখনও পীড়াপীড়ি করিয়াও তাঁহাকে কখনও খেলার সঙ্গী করিতে পারে নাই। তাহাছাড়া অতি অল্প বয়স হইতেই তাঁহার স্বভাব-চরিত্র ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং প্রশংসনীয়। সকলের সাথেই তিনি হাসিমুখে কথা বলিতেন। তাঁহার মুখের বাক্য শ্রবণ করিয়া ও মধুর আচরণ প্রত্যক্ষ করিয়া সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিত। তাঁহার মিষ্টি কথায় সকলেইখুশী হইত। কোন বিষয় লইয়া তিনি কখনও কাহারও সহিত ঝগড়া-কলহ করিতেন না।
তাঁহার অভ্যাস ছিল তিনি খেলা-ধূলায় কিংবা বাজে কাজে সময় নষ্ট না করিয়া সাধ্য অনুযায়ী ছোট ছোট কাজ করিতেন এবং পারিবারিক কাজে চাচা আবু তালিবকে সাহায্য করিতেন। কখনও কখনও তিনি চাচা আবু তালিবের বকরীর পাল লইয়া মাঠে চরাইতে যাইতেন। এই উপলক্ষে মাঠে তাঁহার সমবয় ছেলেদের সাথে দেখা হইত। উহারা তাঁহার আচরণ ও কথাবার্তায় একেবারে মুগ্ধ হইয়া যাইত। সমবয়স্ক ছেলেরা যখন তাহাকে খেলা-ধূলা, করার জন্য আহ্বান করিত, তিনি বলিতেন, আমরা এই দুনিয়াতে খেলা-ধূলা করার জন্য আগমন করি নাই; বরং আমাদের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য রহিয়াছে। তখন তাহারা বলিত, কি সে দায়িত্ব ও কর্তব্য। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দিতে পারিতেন না; কিন্তু তিনি ইহা লইয়া অত্যন্ত ভাবনা-চিন্তা করিতেন ।
সময়ের মূল্য তিনি একান্ত বাল্য হইতেই উপলব্ধি করিয়াছিলেন । অতএব হাতে কোন কাজ না থাকিলে তিনি চুপ করিয়া গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হইতেন। বাল্যে এভাবে চিন্তামগ্ন হওয়া তাঁহার একটা প্রধান পালনীয় কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছিল। তিনি কখনও সুদূর নীল আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকিতেন আবার কখনও ধূসর মরুর দিকে, সবুজ বনের দিকে আবার কখনও তিনি সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতগুলির দিকে, কখনও আকাশের চন্দ্র, সূর্য ও তারকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া কি চিন্তা করিতে করিতে একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িতেন। মনের মধ্যে তাঁহার প্রশ্ন জাগিত, এই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত কাহার সৃষ্টি? আর কে-ই বা এই চন্দ্র ও সূর্যকে উদয়াস্ত করিতেছেন, বাতাস বহাইতেছেন? কাহার হুকুমে এইভাবে দিবা ও রাত্রি হইতেছে? এইভাবে তাঁহার হৃদয়ে শত-সহস্র প্রশ্নের উদয় হইত; কিন্তু তিনি এসব প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক উত্তর না পাইয়া তাঁহার চিন্তা ও ভাবনার মাত্রা দিন দিন বাড়িয়াই যাইতেছিল।
একদা তিনি চাচা আবু তালিবের বকরী চরাইতে দূরবর্তী একটি মাঠে গেলেন। সহসা তাঁহার নিকট অতি প্রিয়দর্শন দুইজন লোক উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদের সৌন্দর্য ও পারিপাট্য মনোমুগ্ধকর। ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এরশাদ করেন যে, আমি তাঁহাদের মত এতসুন্দর লোক আর কখনও দেখি নাই। তাঁহাদের দেহ হইতে উত্তম সুঘ্রাণ নির্গত হইতেছিল। আমি তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিলাম না; কিন্তু পরে জানিতে পারিলাম যে, উহাদের একজন ফেরেশতা জিব্রাঈল এবং অন্যজন ফেরেশতা মিকাইল । তাঁহারা আমার নিকট আসিয়াই সজোরে হাত দুইখানা চাপিয়া ধরিলেন এবং আমাকে মাটির উপরে চিত্তাবে শোয়াইয়া দিলেন। অতঃপর তাঁহারা আমার নাভীদেশ হইতে বক্ষ পর্যন্ত চিড়িয়া ফেলিলেন; কিন্তু আমার তাহাতে কিছুমাত্র কষ্ট হইল না। তাঁহাদের একজন অন্যজনকে বলিলেন, ইহার ভিতর হইতে কুপ্রবৃত্তিগুলি বাহির করিয়া ফেলিয়া দাও এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবরকম বিদ্যা ও জ্ঞান, বিনয়, নম্রতা, দয়া ও সততা প্রভৃতি সদৃগুণাবলির দ্বারা ইহার অন্তর পরিপূর্ণ করিয়া দাও। অপর ফেরেশতা আমার বক্ষ মধ্যস্থ কালো বর্ণের কিছুটা রক্ত বাহির করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। তাহারপর স্নিগ্ধ সুগন্ধিযুক্ত নির্মল পানির দ্বারা আমার রক্তপিন্ড উত্তমরূপে ধৌত করিয়া রৌপ্যের মত শুভ্র কি একবস্তু আমার বক্ষে রাখিয়া দিলেন । তাহারপর আমার ছিন্ন বক্ষস্থল জোড়াইয়া অবিকল পূর্বের মত করিয়া দিয়া আমাকে উঠাইয়া দিয়া বলিলেন, যাও, এবার নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ থাক । তোমার উপর আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হউক।
এবারের ছিনাচাক ছিল হুযুরে পাক (সাঃ)-এর আত্মার দ্বিতীয় দফার আনুষ্ঠানিক শুদ্ধিকরণ। এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুযুরে পাক (সাঃ)-এর অন্তর সর্বজ্ঞানে, বিভূষিত করা হয়। তাঁহার হৃদয়ে দয়া-মায়া, সততা, বিনয়-নম্রতা ও সত্যবাদিতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি গুণে পরিপূর্ণ হয় এবং কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ-মাৎসর্য, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি বিমুক্ত হয়। ইহাছাড়া এই শুদ্ধির মাধ্যমে তাঁহার মধ্যে ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট সহ্য ও পানাহারের প্রতি আগ্রহ নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সঞ্চিত হয়। বস্তুতঃ প্রমাণস্বরূপ দেখা গিয়াছে যে, ক্ষুধা-পিপাসার প্রাবল্যেও তিনি শুধু জমজম কূপের দুই এক পিয়ালা সুপের পানি পান করিয়াই দিনের পর দিন কাটাইয়া দিতে পারিতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হৃদয় হইতে কুপ্রবৃত্তি ও কুকাজসমূহের মূল বুনিয়াদ ধুইয়া মুছিয়া সাফ হইয়া গিয়াছিল। তাই কোন একটি দিনের জন্যও তিনি কখনও একটি অসৎ অন্যায় বা অপছন্দনীয় কাজ করেন নাই। মিথ্যার বীজ তাঁহার ভিতরে শৈশব হইতেই ছিল না। অনেকে মিথ্যা বর্জন করিলেও অন্ততঃ হাসি-তামাশার ভিতরেও দুই-একটি মিথ্যা কথা বলে; কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনে কোনদিন তাহাও হয় নাই। সত্যের মূর্ত-প্রতীক ছিলেন তিনি । তাঁহার প্রাণের শত্রুও একথা বলিতে পারিত না যে, তাঁহার মুখ হইতে বাল্যেও কোনদিন একটি মিথ্যা কথা বাহির হইয়াছে। এইরূপ মহান সত্যের জাজ্জ্বল্যমান অনুপম দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। আর তাই বলিয়াই আরবের লোকগণ তাঁহাকে দুর্লভ আলামীন উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিল।
চলবে।......